Ad Code

বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ইতিহাস (১৯৪৮-২০২৪): উত্থান, সংগ্রাম ও বিতর্ক

সূচিপত্র

    বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (BCL) বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও প্রভাবশালী ছাত্র সংগঠন, যা ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ২০২৪ সালে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এই দীর্ঘ সময়ে সংগঠনটি দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, তবে সহিংসতা ও বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্যও সমালোচিত হয়েছে।


    সূচনা: ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা

    ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি, শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে "পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ" প্রতিষ্ঠিত হয়। নাঈমুদ্দিন আহমেদ ছিলেন প্রথম আহ্বায়ক এবং খালেক নওয়াজ খান ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। সংগঠনটির মূল উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা।


    ইতিহাস: আন্দোলন ও সংগ্রামের ধারাবাহিকতা

    ছাত্রলীগের ইতিহাস বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য। মুক্তিযুদ্ধের সময় ছাত্রলীগের সদস্যরা মুজিব বাহিনীতে যোগ দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেন।


    নামকরণ ও আদর্শের পরিবর্তন

    স্বাধীনতার পর, ১৯৭১ সালে সংগঠনটির নাম পরিবর্তন করে "বাংলাদেশ ছাত্রলীগ" রাখা হয়। এটি আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন হিসেবে কাজ করে এবং মুজিববাদ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে।


    ঐতিহাসিক ভূমিকা: আন্দোলন থেকে ক্ষমতার রাজনীতি

    ছাত্রলীগ দেশের বিভিন্ন আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সংগঠনটি রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের জন্য সহিংসতা ও বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে, যা এর ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ন করে।


    ছাত্রলীগের সহিংসতা: একটি দীর্ঘ ইতিহাস

    ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ছাত্রলীগের হামলায় ৩৩ জন নিহত এবং ১,৫০০ জন গুরুতর আহত হন। ২০১৪ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে এই সংখ্যা বেড়ে ১২৯ জনে পৌঁছে। ২০১৮ সালে এক বছরে ৩১ জন নিহত হন। এই সহিংসতার জন্য সংগঠনটি "হেলমেট বাহিনী" ও "ক্যাডার বাহিনী" নামে পরিচিতি পায়।


    হত্যাকাণ্ড: আলোচিত কিছু ঘটনা

    আব্রার ফাহাদ হত্যা (২০১৯)

    ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর, বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আব্রার ফাহাদকে ছাত্রলীগের সদস্যরা পিটিয়ে হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ড দেশজুড়ে ক্ষোভের সৃষ্টি করে এবং ২৫ জন অভিযুক্তের মধ্যে ২০ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

    তোফাজ্জল হোসেন হত্যা (২০২৪)

    ২০২৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মোবাইল চুরির অভিযোগে তোফাজ্জল হোসেন নামক এক যুবককে ছাত্রলীগের সদস্যরা পিটিয়ে হত্যা করে। এই ঘটনায় ছয়জন ছাত্রলীগ সদস্যকে অভিযুক্ত করা হয়।

    নাহিদ হোসেন হত্যা (২০২২)

    ২০২২ সালের ১৯ এপ্রিল, ঢাকার নিউ মার্কেট এলাকায় সংঘর্ষের সময় নাহিদ হোসেন নামক এক কুরিয়ার কর্মী ছাত্রলীগের সদস্যদের হাতে নিহত হন। এই ঘটনার পর ছয়জন ঢাকা কলেজের ছাত্রকে প্রধান সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

    বিশ্বজিৎ দাস হত্যা (২০১২)

    ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর, ঢাকার শাঁখারীবাজারে বিশ্বজিৎ দাস নামক এক সাধারণ নাগরিককে ছাত্রলীগের সদস্যরা প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ডের জন্য আটজনকে মৃত্যুদণ্ড ও ১৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।


    ধর্ষণ ও নারীর প্রতি সহিংসতা

    ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে ধর্ষণ ও নারীর প্রতি সহিংসতার অভিযোগ উঠেছে। এই ধরনের কর্মকাণ্ডের জন্য সংগঠনটি ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে এবং এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা প্রতিবাদ জানায়।


    কোটা সংস্কার আন্দোলন: ছাত্রলীগের ভূমিকা

    বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন ছিল এক যুগান্তকারী ছাত্র আন্দোলন, যা ২০১৮ সালে শুরু হয়ে তরুণদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে দেয়। মূলত সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতির সংস্কারের দাবিতে এই আন্দোলন শুরু হয়। ছাত্র, তরুণ, ও সাধারণ চাকরিপ্রত্যাশীরা এতে অংশ নেন, যার নেতৃত্বে ছিলেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এই আন্দোলন ছিল ছাত্র রাজনীতির ইতিহাসে একটি ব্যতিক্রমী উদাহরণ, কারণ এতে কোনও রাজনৈতিক দলের আনুষ্ঠানিক নেতৃত্ব ছিল না—বিকল্প নেতৃত্ব গড়ে উঠেছিল ‘সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’-এর ব্যানারে।

    ২০১৮ সালের প্রেক্ষাপট

    সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থায় মোট ৫৬ শতাংশ পদ ছিল বিভিন্ন কোটাভিত্তিক বরাদ্দে। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ছিল ৩০ শতাংশ, নারী ও জেলায় অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য কোটাসহ নানা ক্যাটাগরি ছিল। সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল, এই কোটাব্যবস্থা অপ্রয়োজনীয়ভাবে মেধাবীদের ঠেকিয়ে দিচ্ছে এবং প্রশাসনে বৈষম্য তৈরি করছে।

    ২০১৮ সালের মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্দোলন শুরু হয়, পরে তা দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়ে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর, বুয়েটসহ সারাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী রাস্তায় নেমে আসে। ছাত্রলীগ সেই সময় সরকারপন্থী অবস্থান নেয় এবং আন্দোলনকারীদের উপর হামলার অভিযোগ ওঠে।

    সরকারের প্রতিক্রিয়া

    আন্দোলনের চাপের মুখে ২০১৮ সালের জুলাই মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দেন—সরকারি চাকরিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোটা বাতিল করা হবে। তবে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে দ্বিধা ও কালক্ষেপ দেখা যায়, যা আন্দোলনকারীদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করে।

    ছাত্রলীগের ভূমিকা

    কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্রলীগের ভূমিকা ছিল দ্ব্যর্থপূর্ণ। একদিকে সংগঠনটি দাবি করে যে তারা সংস্কারের পক্ষে, অন্যদিকে মাঠপর্যায়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারীদের উপর হামলা চালায়, হুমকি দেয় এবং আন্দোলন দমাতে সহায়তা করে। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিন, টিএসসি ও বিভিন্ন হলে মারধরের অভিযোগ উঠে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে।

    এই ঘটনার মাধ্যমে সাধারণ ছাত্রসমাজের মধ্যে ছাত্রলীগের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তারা "হেলমেট বাহিনী" নামে সমালোচিত হতে থাকে। এই সময় আন্দোলনকারী ছাত্রদের ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়, যা জনমতকে আরও তীব্রভাবে আন্দোলনকারীদের পক্ষে নিয়ে যায়।

    ২০২৪ সালের পুনরুত্থান

    ২০২৪ সালে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা আবারও কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে আন্দোলন নতুন করে জোরদার হয়। শিক্ষার্থী ও তরুণ চাকরিপ্রত্যাশীরা ঢাকাসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে বিক্ষোভ শুরু করে। তবে এবার সরকার আরও কঠোর অবস্থান নেয় এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি ছাত্রলীগ সদস্যদের সহিংস ভূমিকা সামনে আসে।

    বিশেষ করে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর ছাত্রলীগ ও পুলিশের যৌথ হামলায় কয়েকজন নিহত হন এবং শতাধিক আহত হন। গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই ঘটনাকে “জুলাই গণহত্যা” নামে আখ্যায়িত করে।

    এই সহিংস দমন প্রক্রিয়ার ফলে আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশ সরকারের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে এবং ছাত্রলীগের সহিংস ভূমিকার কারণে সংগঠনটির উপর নিষেধাজ্ঞার দাবি জোরালো হয়।

    আন্দোলনের ফলাফল

    এই আন্দোলনের চাপেই ২০২৪ সালের ২৩ অক্টোবর সরকার ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করে এবং পরে আওয়ামী লীগের সকল কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। কোটা সংস্কার আন্দোলন, যেটি শুরু হয়েছিল ন্যায়বিচারের দাবিতে, তা একসময়ে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবর্তনের শক্তিশালী অনুঘটকে পরিণত হয়।


    নিষিদ্ধ ঘোষণা: ছাত্রলীগের পতন

    ২০২৪ সালের ২৩ অক্টোবর, বাংলাদেশ সরকার ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করে এবং এর সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে। এই নিষেধাজ্ঞা ২০২৫ সালের ১১ মে আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম নিষিদ্ধের মাধ্যমে আরও বিস্তৃত হয়। এই সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।


    উপসংহার: একটি ইতিহাসের সমাপ্তি

    বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ইতিহাস গৌরবময় আন্দোলন ও সংগ্রামের পাশাপাশি সহিংসতা ও বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে পরিপূর্ণ। সংগঠনটি দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর কর্মকাণ্ড সমালোচিত হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

    Close Menu